৬ আগস্ট, ২০০৬। হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠ, বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ের মধ্যকার ৫ম ওয়ানডে ম্যাচ। বাংলাদেশের হয়ে অভিষেক হলো এক তরুণের, সাকিব আল হাসানের। সিরিজে তখন ২-২এ সমতা। সিরিজ নির্ধারনী ম্যাচে টসে জিতে ব্যাটিংয়ে জিম্বাবুয়ে। ২৩তম ওভারে দলের পঞ্চম বোলার হিসেবে বোলিংয়ে এলেন সাকিব। সেদিন টানা ১০ ওভার বল করে ৩৯ রানে ১ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে ৩০ রানে অপরাজিত থেকে জয়ি হয়ে ছেড়েছিলেন মাঠ। এরপর পেরিয়ে গেছে ১৫টি বছর, সাকিবও হয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারদের একজন।
২০০৬ সালে অভিষেক হলেও, ২০০৯ থেকেই মূলত বিশ্ব ক্রিকেটে সাকিবের দাপটের শুরু। ২০০৯ সালে সাকিব ৩৮৭ রেটিং পয়েন্ট নিয়ে চলে আসেন ওয়ানডের অলরাউন্ডারদের শীর্ষে। সেই যে শুরু, একযুগ পরও চলছে তাঁর র্যাঙ্কিং-রাজত্ব। ওয়ানডেতে সাকিবের সর্বোচ্চ রেটিং ২০০৯ সালের ৪৫৩। যা এই সময়ের পরে আর টপকাতে পারেনি কোনো অলরাউন্ডারই।
সাকিবই ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র অলরাউন্ডার. যিনি ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটে একই সময়ে ছিলেন অলরাউন্ডারদের র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে। ওয়ানডে ক্রিকেটে সাকিব শীর্ষে ছিলেন ৩২৪ সপ্তাহ ধরে। কাছাকাছি থাকা ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিস শীর্ষে ছিলেন ২০৩ সপ্তাহ। সেসময় সাকিবের দাপট বোঝাতে ইএসপিএনক্রিকইনফো, টেনিসের দুই কিংবদন্তি সেরেনা উইলিয়ামস ও রজার ফেদেরারের সাথে তুলনা করেছিলেন সাকিবের। সেরেনা শীর্ষে ছিলেন ৩১৬ সপ্তাহ, রজার ফেদেরার ২৩৭ সপ্তাহ। আর, সাকিব? ৩২৪ সপ্তাহ!
ক্রিকেট যদি একক খেলা হতো, তাহলে কি সাকিব সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হয়ে যেতেন? উত্তর যেটাই হোক না কেনো, দিনশেষে ক্রিকেট তো ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে দলেরই খেলা। আর এখানেই সাকিব পিছিয়ে। তানাহলে বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে ওমন অতিমানবিয় পারফর্ম করার পরে সাকিব তো ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের অংশই হয়ে যাবার কথা। ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ৬০৬ রান আর ১১ উইকেট তো অন্তত এমন বার্তাই দেয়। এমন চোখ ধাধানো পারফর্ম্যান্সের পরেও সাকিবকে নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে ফাইনাল জেতানো বেন স্টোকসকে নিয়ে। সাকিবের দল যদি অষ্টম না হয়ে প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা সেমিফাইনাল খেলতো তাহলেও কি দৃশ্যপটটা একইরকম থাকতো?
বলে রাখা ভালো, সাকিবই ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র অলরাউন্ডার, যাঁর বিশ্বকাপে এক হাজার রানের সঙ্গে আছে ৩০টি উইকেটও। ওয়ানডে বিশ্বকাপে সাকিবই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি এক বিশ্বকাপে ৬০০ রান ও ১০ উইকেট নিতে পেরেছেন। এই অর্জন নেই ক্রিকেট ইতিহাসেই আর কারোর।
শুধু ওয়ানডে ক্রিকেটেই নয়, সাকিব আলো ছড়িয়েছেন অন্য দুই ফরম্যাটেও। রেকর্ড গড়েছেন, ভেঙ্গেছেনও। নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। তার হাত ধরেই এসেছে দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো পরাশক্তির বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়।
সাকিবের ওয়ানডে রান ৬৬০০, টেস্ট রান ৩৯৩৩, আন্তর্জাতিক টি২০ রান ১৬৬৬। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১২১৯৯ রানের মালিক সাকিব; বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি উইকেট সাকিবের। ওয়ানডে, টেস্ট আর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে যথাক্রমে ২৭৭, ২১৫ এবং ৯৭টি উইকেট সাকিবের। অস্ট্রেলিয়ার সাথে চলমান টি-টোয়েন্টি সিরিজে আর মাত্র ৩টি উইকেট পেলেই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে পূর্ণ করবেন ১০০ উইকেটের মাইলফলক। সেইসাথে অনন্য এক রেকর্ডও। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে যে ১৫০০ রান এবং ১০০ উইকেট নেই আর কারোরই।
টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে দ্রুততম ৩০০০ রান ও ১৫০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব সাকিবের। ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে ৬০০০ রান ও ২৫০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন সাকিব। সাকিবসহ মাত্র তিনজন ক্রিকেটারের একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব রয়েছে। একই টি২০ ম্যাচে রয়েছে পাঁচ উইকেট ও ৪০ এর অধিক রান। প্রথম বাঁহাতি বোলার হিসেবে টি২০ ক্রিকেটে ৩০০ উইকেট সাকিবের; ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় অলরাউন্ডার হিসেবে টি২০ ক্রিকেটে ৪০০০ রান ও ৩০০ উইকেটের মাইলফলক রয়েছে সাকিব আল হাসানের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫০০ উইকেট নেওয়া প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশি সাকিব।
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে ১০০০ রানের মাইলফলক ছুঁয়েছেন সাকিব। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি তার দখলে। এছাড়া বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ডটিও সাকিবের।
দেশের মাটিতে ৬০০০ রান এবং ৩০০ উইকেট নেয়া একমাত্র ক্রিকেটার তিনি। এই রেকর্ড নেই বিশ্বের দ্বিতীয় কোন ক্রিকেটারের, এমন কি একটা নির্দিষ্ট দেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫ হাজার রান ও ৩০০ উইকেটও নেই কারোরই। ৪ হাজার রান ও ৩০০ উইকেট আছে শুধুমাত্র দুজনের, তারা হলেন দক্ষিণ আফ্রিকান অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিস ও ভারতীয় অলরাউন্ডার কপিল দেব।
গত ১৫ বছরে সাকিব রেকর্ডের বরপুত্রে পরিণত করেছেন নিজেকে। দেশের হয়ে প্রায় সব রেকর্ডেই আছে তার নাম। বিশ্বক্রিকেটেও সাকিবের দাপট কমেনি। দাপটের সাথেই খেলে যাচ্ছেন ফ্যা্রঞ্চাইজি লিগগুলোতে। আইপিএল, সিপিএলের মতো টুর্নামেন্টগুলোতে জিতেছেন শিরোপাও। বিভিন্ন সময়েই নানান বিতর্কের জন্ম দিয়ে ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হলেও সাকিব প্রতিবারই ফিরেছেন দাপটের সাথেই, স্বমহিমায়। জায়গা করে নিয়েছেন এক যুগের সেরা ওয়ানডে দলেও। ভেসেছেন ক্রিকেট ইতিহাসের সেরাদেরও সেরার প্রসংসায়।
শতশত অর্জন যার নামে, তার নামের পাশে নেই শুধু একটি বিশ্বকাপের ট্রফি। এই ট্রফি না জিততে পারার আক্ষেপ যতটা না লেখক, পাঠকের, তারচেয়েও যে অনেক বেশি সাকিবের হয়ে থাকবে, সেটা না বললেও বুঝে নেয়া যায়। এই একটা মাত্র অপূর্ণতার জন্যই হয়তো এতএত অর্জনের পরেও তার নাম উচ্চারিত হবে না ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের আলোচনায়। হয়তো চিরদিন থেকে যাবেন ইয়ান বোথাম, কপিল দেবদের ছায়াতলেই। সম্ভবত ২০২৩ বিশ্বকাপই হতে যাচ্ছে সাকিবের শেষ বিশ্বকাপ। সাকিব বলেই হয়তো স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করছে বিশ্বকাপ জয়েরও। শেষে এসেই তো ক্যারিয়ারের পূর্ণতা পেয়েছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরা ব্যাটসম্যান শচীন রমেশ টেন্ডুলকারও।