বাংলাদেশের কাছে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজে পরাজয়। এবার যখন লাল সবুজের এই দেশে অস্ট্রেলিয়া প্রথম পা রেখেছিলেন, তখন কি ভুল করেও ভেবেছিলেন দেশে ফিরতে হবে নীল হয়ে! বলা হয়, বেদনার রঙ নাকি নীল। আসলেই নীল কি না সেটা এইমুহুর্তে অজিদের চেয়ে ভালো আর কে বা জানে!
এত সুন্দর একটা দেশ বাংলাদেশ, অথচ কখনোই এদেশে আসার আগ্রহও দেখায়নি অজিরা। পাশের দেশ ভারতে নিয়মিত খেলতে গেলেও বাংলাদেশে এসেছে কালেভদ্রে। যেন বাংলাদেশ এলাকার ছোট বাচ্চা, যে মনেপ্রাণে খেলতে চায় কিন্তু বড়রা তাকে দিয়ে শুধু বলই কুড়োয়। ভাবটা এমন যেন তার যোগ্যতাই শুধু বল কুড়ানোর। এটা যে কি পরিমাণ বেদনার সেটা যদি অজিরা জানতো!
অস্ট্রেলিয়ায় হয়তো এদেশের মতো দাদী-নানীরা ছোটবেলায় গল্প শোনায় না। যদি শোনাতো, হয়তো ওরাও বুঝতো দুর্দিন চিরদিন থাকেনা, সুদিনও ফুরোয় কখনো কখনো। ওদের গল্পের বইগুলোতে হয়তো বিশাল সাম্রাজ্য থাকে, তবে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া রাজার গল্প লেখা হয় না। হয়তো ওদের দেশে বানানো চলচিত্রগুলোতে এমন কোনো দৃশ্যই থাকে না, যেখানে নিচু জাতির উপর অত্যাচার চালানো হয়। তা না হলে তো ওরাও জানতো শেষ অব্দি এর পরিণতি কি হয়!
অথবা, হয়তো ওদের দেশের দাদী-নানীরাও ছোটবেলায় গল্প শোনায়, ওদের গল্পের বই কিংবা সিনেমাতেও জুলুমের দৃশ্য থাকে, সুন্দর পরিণতি থাকে। শুধুমাত্র ম্যাথু ওয়েডরাই হয়তো বড় হয়ে ভুলে গেছে। কিংবা, মনে রাখার প্রয়োজনই অনুভব করেনি।
পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে তখনও বাংলাদেশে আসেইনি তারা, অথচ জুড়ে দিয়েছিলো কতগুলো শর্ত! এ তো এলাকার সেই বড় ভাইটার মতোই, সে যেভাবে ভাববে সব সেভাবেই হতে হবে। আর, এলাকার ঐ ছোট বাচ্চাটার মতোই আমাদের সামনে কোনো পথ অবশিষ্ট নেই, তাদের শর্ত মেনে নেয়া ছাড়া। ওদের সব শর্তই মেনে নেয়া হলো, বহু প্রতিক্ষিত সিরিজটাও মাঠে গড়ালো। প্রথম ম্যাচে ব্যাটিংয়ে পাঠালো টাইগারদের, স্কোরবোর্ডে তোলাই গেলো মাত্র ১৩১টি রান। মাত্র ১৩১! মাইটি অজিদের জন্য তো মাত্রই।
এলাকার সেই ছোট ছেলেটা এখন আর ছোট নেই। এত এত অবহেলা, অনীহা! নির্ঘুম কত রাত কেঁটেছে, কতবার যে বৃষ্টিতে লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে নিজের চোখের জলকে! এত শত অপমানের জবাব তো কখনো না কখনো দিতেই হতো, তা না হলে তো পরবর্তী প্রজন্মকেও তাদের সামনে দাড়াতে হতো চোখ নামিয়েই। সেই যে আশরাফুল একবার কার্ডিফে চোখে চোখ রেখে খেলেছিল, এরপর পেরিয়ে গেছে ১০টি বছর। অজিরা টেস্ট খেলতে এলো বাংলাদেশে; সাকিব-মিরাজের ঘুর্ণিপাকে খুঁজে পেলো না পরিত্রানের পথ। এবার আবার যখন অজিরা বাংলাদেশে এলো, ততোদিনে পেরিয়ে গেছে আরও ৪টি বছর। টি-টোয়েন্টিতে কখনোই ওদের বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারা টাইগাররা এবারেও পারবে না, এমনটাই হয়তো ভেবেছিলো অজিরা।
কোথায় যেন ছিলাম? ও আচ্ছা, প্রথম টি-টোয়েন্টিতে। টাইগারদের সংগ্রহ ১৩১। অজিরা ব্যাটিংয়ে, জয়ের জন্য প্রয়োজন মাত্র ১৩২ রান। ‘এই ম্যাচ তো জিতবোই’ হয়তো এমনটাই ছিল অজিদের ভাবনায়। কিন্তু সবসময়েই বড়দের সাথে সাথে খেলে যে ছোটদের সাথে খেলাই হয়নি কখনো অজিদের! ছোটদের তো চিরদিন রেখেছেন অপেক্ষায়; ভেবেছেন তারা আবার বড়দের সাথে কিসের ক্রিকেট খেলবে! ছোটদের ছোট মনে করাটাই কাল হয়ে দাড়ালো মাইটি অজিদের জন্য। নাসুম আহমেদের ঘুর্ণিতে কোনোরকমে ১০০ করতে পারলো অজিরা। পরিত্রানের পথ খুঁজেই পেলো না, পরাজয় বরণ করতে হলো ২৩ রানে। এরপর পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই ভুগতে হয়েছে অজিদের। ৫টি ম্যাচে জয় এসেছে মাত্র ১টিই, ৪-১ ব্যবধানে সিরিজে পরাজিত হয়ে মাথা নীচু করেই ফিরতে হচ্ছে ক্যাঙ্গারুর দেশের রাজাদের।
নাসুম-সাকিব-মাহেদি ত্রয়ি তো ভুগিয়েছেনই, অজিদের ভুগতে হয়েছে সাইফুদ্দিন-শরিফুল-মুস্তাফিজেও। আলাদা করে ফিজের কথা বলতেই হয়। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে বাচ্চাটা যেভাবে বল করলো, তাতে শুধু ক্রিকেটপ্রেমিরাই মুগ্ধ হয়নি, চোখ জুড়িয়েছে এলাকার বড় ভাইদেরও। এটাই তো প্রাপ্তি, সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
অজিরা চলে যাচ্ছে, তাদের যাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। প্রথমবার যখন দেশের মাটিতে পা রেখেছিলো, তখন হয়তো তারা ভাবেওনি এভাবে ফিরতে হবে। কিন্তু ওরা না আসলে তো এমন আনন্দ, এত এত অর্জন, নতুন এক পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের আবিষ্কার করা, কোনোটাই হতো না আমাদের। আত্মবিশ্বাস থাকলেও সেটা তো নতুন করে খুঁজে পাওয়াও এই সিরিজেই। অজিদের এই সফর আমাদের দু হাত ভরে শুধু দিয়েই গেছে, আর দিয়েই গেছে। এমন একজনকে যদি বিদায়টাও ভালোমতো জানাতে পারি, তাহলে তো সেটা হয়ে থাকবে আজন্মের আক্ষেপ।
“ধন্যবাদ, প্লিজ আবার আসবেন।“