বেশ কয়েক বছর আগেই বেন স্টোকস আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ক্রিকেট ঘৃণা করি’। কেনই বা করবেন না? ক্রিকেটের কারণে বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে পারেননি। বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। কিন্তু ছেলে হয়ে বাবার শেষ সময়টায় পাশে থাকতে পারেননি।
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জন্ম বেন স্টোকসের। দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা রাগবি, ক্রিকেট কিছু সংখ্যক মানুষ দেখেন, সেটাও সময় পেলে। বাবা জেরার্ড স্টোকস ছিলেন রাগবি দলের কোচ, ইচ্ছা ছিল ছেলেকেও বানাবেন রাগবি খেলোয়াড়। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্টোকসকে রাগবি খেলোয়াড় বানাতে পারেননি বাবা জেরার্ড, তবে একটা সময় পেরোবার পর চাইতেন তার ছেলে ক্রিকেট খেলে সবাইকে আনন্দ দিক।
স্টোকসের যখন ১২ বছর বয়স, তখনই ইংল্যান্ডে চলে যায় তার পরিবার। বাবা ক্যানটারবেরি আগস্টিন থেকে ওয়াশিংটন শহরে গিয়ে রাগবি লিগ ক্লাবের প্রধান কোচ বনে যান। সেই হিসেবে ছেলেও যাবেন রাগবিতে, তা অনুমেয়ই ছিল। কিন্তু ছোট থেকেই বেনের ঝোঁক ছিল ক্রিকেটের দিকে; চাইতেন ক্রিকেট খেলবেন, মানুষকে আনন্দ দেবেন। বেন স্টোকসের বয়স যখন ১৮, তখন রস টেইলর তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন আছে কি না! ২০১০ সালে ডারহামের হয়ে কাউন্টি খেলার সময়ে স্টোকসকে নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলার কথাও বলেন টেইলর।
টেইলর তার আত্মজীবনীতেও উল্লেখ করেছেন, “স্টোকসি বেশ সিরিয়াস ছিল নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলার জন্য। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের উচিত ছিল বিষয়টিকে সহজ করার।”
টেইলর স্টোকসকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে নিউজিল্যান্ডে নিতে চাইলেও শেষমেশ তা আর হয়ে উঠেনি। কারণ নিউজিল্যান্ড বোর্ড স্টোকসের সরাসরি দলে জায়গা পাওয়ার ব্যাপারে সহমত ছিল না, তাদের শর্ত ছিল আগে স্টোকসকে নিউজিল্যান্ডের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে শুরু করতে হবে। পরবর্তীতে কী হয় দেখা যাবে। কিন্তু স্টোকস সেই প্রথম থেকে আবার শুরু করতে চাননি।
রাগবি পর্ব শেষে বাবা-মা নিউজিল্যান্ডে ফিরে গেলেও স্টোকস ক্রিকেটকে ভালবেসে থেকে গিয়েছিলেন ওয়াশিংটনেই। সেখানেই নিয়মিত অনুশীলন করেছেন। বয়স ভিত্তিক দল থেকে একটা সময় জাতীয় দলের নায়ক একজন বেন স্টোকস হলেও ইংল্যান্ড ক্রিকেটে অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র।
পানশালায় থেকে ফেরার সময় পথে ঝামেলায় জড়ান, একপর্যায়ে হাতাহাতি থেকে সংবাদের শিরোনামে ছিলেন বেন। মানসিক অবসাদ ইস্যুতে ক্রিকেট থেকে নিয়েছিলেন বিরতি, ওয়ানডে থেকে অবসরও নিয়েছেন। কিন্তু এবার সমস্ত বাধাকে উপেক্ষা করে যেন আবারও ফিরে এসেছেন বাইশ গজের ময়দানে। সিচুয়েশন যাই হোক, বিপক্ষে যেই থাকুক স্টোকস একটা কথাতেই বিশ্বাস করেন তিনি ম্যাচ জিতে ড্রেসিংরুমে ফিরবেন। যত প্রতিকূল পরিস্থিতিই আসুক দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যেতে হবে।
এবার যেন ২০১৬ সালে ইডেন গার্ডেনের লজ্জার দায় মোচনের সুযোগ। শেষ ওভারে ১৮ রান ডিফেন্ড করার জন্য তার হাতেই বল তুলে দিয়েছিলেন ইয়ন মরগ্যান। কিন্তু কার্লোস ব্রাথওয়েট বেদম পেটালেন তাকে, টানা চার বলে ছক্কা হাঁকিয়ে স্টোকসকে ভেঙ্গে চূর্ণ করে দিয়েছিলেন। ছয় বছর পরে সেই হারের দায় মোচন ঘটালেন স্টোকস।
২০১৯ সালে আকাশি রঙের জার্সি পরে বিশ্বজয় করেছিল ইংল্যান্ড। ট্রফি হাতে ইংরেজ ক্রিকেটারদের উল্লাসের মধ্যেই চোখে পড়েছিল মাটি মাখা স্টোকসের জামা।
মেলবোর্নেও রবিবারে ঘটলো তার পুনরাবৃত্তি। সিঙ্গেলস, ডাবলস নিতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলেন স্টোকস, হ্যারিস রউফের থ্রোটা ডিরেক্ট স্টাম্পে লাগলে হয়তো গল্পটা ভিন্ন হতো। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার লেখা স্ক্রিপ্ট হয়তো এমনই ছিল, বেন স্টোকসই শেষ করবেন ইনিংসটা।
ডাইভ দিয়ে কোনও মতে নিজের উইকেট বাঁচিয়েছেন, গোটা ম্যাচেই খুঁড়িয়েছেন। কিন্তু যন্ত্রণা তো আর সব আটকে রাখতে পারবে না। সময়ের অন্যতম সেরা বোলিং লাইন আপের সামনে দাঁড়িয়ে শক্ত হাতে খেলে গেলেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে প্রথম হাফ সেঞ্চুরি করলেন এই দিনেই। ডিপ মিড উইকেটে শেষ রান নিয়ে করলেন এক প্রকার বুনোউল্লাস। জানান দিলেন পৃথিবীতে এখনও ইংরেজদের সাম্রাজ্যের শেষ হয়ে যায়নি, এখনও চলে ইংরেজদের রাজতন্ত্র।
যেই একটা ওয়ানডে বিশ্বকাপের জন্য ইংল্যান্ডকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৪৪ বছর, সেটার অবসান ঘটেছিল স্টোকসের হাত ধরেই। আবারও স্টোকসের হাত ধরে ১২ বছর পর ২০ ওভারের ক্রিকেটের শিরোপা ঘরে তুলল ইংল্যান্ড। মঞ্চ যখন বিশ্বকাপ ফাইনালে রূপকথার নায়ক সেই এক জনই হবেন তাই নয় কি? তার নাম বেন স্টোকস।